চট্রগ্রাম প্রতিনিধি :::
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৬৮টি কারাগারে দিন দিন বাড়ছে হাজতির সংখ্যা। ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি বন্দি হওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে বন্দিদের। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, কারাগারে বন্দিদের যে অধিকার তা প্রতিপালন করা না হলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। ধারণক্ষমতার প্রায় আড়াইগুণ বেশি বন্দি সামাল দিতে বেসামাল হয়ে পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। তীব্র গরমে কারা অভ্যন্তরে বন্দিদের দুর্দশা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাড়ছে গরমজনিত নানা রোগব্যাধি। চিকিৎসাও মিলছে না যথাযথ। অনেকটা মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। প্রায় একই চিত্র ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের অন্যান্য কারাগারগুলোতে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তা জানান, আমাদের কিছু করার নেই। আসামি কারাগারে পাঠালে আমাদের ফেরত পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। আমাদের যে কোনো উপায়ে তা ‘কনজিউম’ করতে হয়। তবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার জাহেদুল আলম আজাদীকে জানান, বিশেষ অভিযানে কারাগারে তেমন প্রভাব পড়ছে না। বন্দি আগে হয়তো দৈনিক ৭০/৮০ জন আসতো, এখন ১০০/১১০ জন আসছে।
দেশব্যাপী গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাস মোকাবেলায় পরিচালিত সপ্তাহব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযানে চট্টগ্রামে এক হাজার ৯৪৭ জনকে আটক করে পুলিশ। গত শুক্রবার ভোরে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী সপ্তাহব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শেষ হয়। এছাড়া শুক্রবার রাতভর নগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পুলিশের নিয়মিত অভিযানে বিভিন্ন মামলার ২৬০ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে বিশেষ অভিযান কিংবা নিয়মিত অভিযান, যা–ই বলা হোক না কেন, পুলিশ অভিযানের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ধরপাকড় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে এর মধ্যেই। বিএনপির নেতাকর্মীদের দাবি–জঙ্গি দমনে চলমান অভিযানে ‘জঙ্গি’র চেয়েও বিএনপি নেতাকর্মীদের ‘গ্রেপ্তার–হয়রানি’তেই পুলিশের মনোযোগ বেশি। ঈদের পর বিএনপির সম্ভাব্য আন্দোলন রুখে দিতেই দলটির নেতাকর্মীদের আটক করা হচ্ছে। তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ পুলিশ। সিএমপি কমিশনার মো. ইকবাল বাহার পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলছেন, এ পর্যন্ত কয়জন বিএনপি নেতাকে আটক করা হয়েছে? এ পর্যন্ত যতজনকে আটক করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।
কারাগারের একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬ টি পাঁচতলা ভবনের ১২০টি ওয়ার্ডে বন্দি ৫ হাজার ৮৪০ জনের মধ্যে ৪ হাজার ৮৮২ জন হাজতি ও প্রায় এক হাজারের মতো কয়েদি রয়েছে। কারাগারে বন্দি পুরুষদের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে ৯০০ জন। এর মধ্যে সশ্রম কারাভোগ করছেন ৬০১ জন ও বিনাশ্রম কারাভোগ করছেন ২৯৯ জন। আর নারী বন্দিদের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত রয়েছেন ৪৩ জন। এর মধ্যে সশ্রম কারাভোগে আছেন ১৭ জন ও বিনাশ্রম কারাভোগ করছেন ২৬ জন। বন্দিদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে ৪৫ জন। এর মধ্যে ৪৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা। এছাড়া কারাগারে মহিলা বন্দি রয়েছে ২৬২ জন। মায়ের সঙ্গে হাজতবাস করছে ৪৩ জন শিশু। এর মধ্যে ২৯জন ছেলে ও ৩২জন মেয়ে। আর কিশোর অপরাধী ২০ জন। বন্দিদের মধ্যে প্রায় ৮ শতাধিক ছাত্রও রয়েছে। যাদের অধিকাংশই মাদক আইনে আটক রয়েছে বলে জানান কারা কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন অভিযোগে চট্টগ্রাম মহানগর ও ১৪ উপজেলা থেকে আটককৃতদের দিন শেষে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। ধারণক্ষমতার বেশি হওয়ায় বন্দিরা যেমন পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছে না, তেমনি লোকবল সঙ্কটের কারণে হিমশিম খেতে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে। এতে করে বন্দিদের মাঝে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার জানান, জেলকোড অনুযায়ী প্রতিজন বন্দির জন্য দৈর্ঘ্য আর প্রস্থে ৬ ফুট করে জায়গা বরাদ্দ রয়েছে। আর একজন কারাবন্দির জন্য এত বিশাল জায়গার সত্যিই প্রয়োজন নেই। এছাড়া ভবনগুলোতে পর্যাপ্ত করিডোর ও কক্ষগুলো বড় পরিসরের হওয়ায় দশজনের জায়গায় পনের জন করে থাকতে বন্দিদের কোন সমস্যায় পড়তে হয় না বলেও জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট জিয়া হাবিব বলেন, যে হারে মামলা ও অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে সেই তুলনায় কারাগারে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। চট্টগ্রাম শুধু নয়, সারাদেশের কারাগারগুলোতে কয়েক গুণ বেশি বন্দি রাখতে হচ্ছে। এটা সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লংঘন। সরকার বিশেষ অভিযান যখন চালায়, তখন তদন্তের স্বার্থে অনেককে ধরা হয়, পরে দেখা যায়– তারা নিরপরাধ। এদের দ্রুত জামিন দেয়া গেলে, কারাগারে বন্দি দুর্ভোগ কিছুটা লাঘব হতো। কিন্তু বিচারক সংকটের কারণে দিনের পর দিন মামলার শুনানি থমকে আছে। গ্রেপ্তার হচ্ছে, দ্রুত তদন্ত কার্য শেষ করে আদালতে পাঠানো হচ্ছে, আদালত থেকে প্রকৃত অপরাধীদের রেখে অন্যদের জামিন দিচ্ছে, এভাবে প্রক্রিয়াটা যদি গতিশীল থাকতো তবে সংকট অনেকটাই কম হতো। তা না হওয়ার কারণে কারাগারগুলোতে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে বন্দিদের।
জানা গেছে, ১৮৮৫ সালে নগরীর লালদীঘি পাড় এলাকায় ১১ দশমিক ৫৫ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত কারাগারকে ১৯৯৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে উন্নীত করা হয়। ওই সময় বন্দী রাখার ধারণ ক্ষমতা ছিল মাত্র ৪’শ জন। পরবর্তীতে কারাগারের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন করার পর ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার ৮৫৩ তে উন্নীত করা হয়।
বন্দি রাখার জন্য কারাগার অভ্যন্তরে রয়েছে ছোট বড় ৩৫টি ভবন। যার ১৫টিতে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি ও অন্যগুলোতে প্রতিদিন আসা বন্দিদেরকে রাখা হয়।
পাঠকের মতামত: